গরু মোটাতাজাকরনে আধুনিক পদ্ধতি

আমাদের দেশের প্রায় ৭০ ভাগ গ্রামীণ পরিবারই পশু প্রতিপালনের সঙ্গে জড়িত থাকলেও গরু মোটাতাজাকরণ কলা কৌশল বাপ্রযুক্তি ব্যবহারকারী পরিবারের সংখ্যা খুবই কম। তবে গরু মোটাতাজাকরণ প্রকল্পের গুরুত্ব না জানলেও অনেক পরিবার একটি বা দুটি বাড়ন্ত এড়ে গরু ক্রয় করে প্রযুক্তি ব্যতিরেকে সাধারণভাবে লালন পালন করে যখন স্বাস্থ্য ভাল হয় তখন বিক্রয় করে দেয়। সাধারণত বেশি বিক্রয়মূল্য পাওয়ার আশায় অধিকাংশ লোকই কোরবানীর সময় তাদের পালনকৃত গরু বিক্রয় করেন। বিষয়টি সর্ম্পকে স্পষ্ট ধারণা, ব্যাপক প্রচার ও প্রশিক্ষণের অভাবে প্রযুক্তিটি  ব্যপকভাবে পরিচিতি পায়নি। তথাপি সরকারী, আধাসরকারী ও এনজিও প্রতিষ্ঠানসমূহ প্রোটিনের চাহিদা মেটানো, কর্মস্থান, দারিদ্র বিমোচন ও বেকার  যুবকদের আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে গরু মোটাতাজাকরণের উপর বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, আর্থিক অনুদান, সহজ উপায়ে লোন ইত্যাদি দিয়ে সহযোগিতা করছে। আশা করা যায় ভূমিহীন নর-নারী ও বেকার যুবকদের আয় ও কর্মস্থানের ক্ষেত্রে এ প্রযুক্তি ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।
গরু মোটাতাজাকরণ বা বীফ ফ্যাটেনিং (Beef Fattening)বলতে কিছু সংখ্যক গরু বা বাড়ন্ত বাছুরকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় এবং উন্নত সুষম খাবার সরবরাহ করে ঐ গরুর শরীরে অধিক পরিমাণ মাংস/চর্বি বৃদ্ধি করে বাজারজাত করাকেই বুঝায়।

২২.১ গরু মোটাতাজাকরণের উদ্দেশ্য

১. দেশে আমিষের চাহিদা পূরণ
২. বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের জন্য চামড়া শিল্পের সমৃদ্ধি
৩. জাতীয় আয় বৃদ্ধি করা ও বেকার সমস্যার আংশিক সমাধান করা
৪. জৈব সার সহজলভ্য করা
৫. পরিবেশ দূষণমুক্ত ও গবাদিপশুজাত শিল্প গড়ে তুলতে পারে।
৬.বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপনের মাধ্যমে গোবর থেকে গ্যাস আহরণ করে ব্যবহার করা যেতে পারে।
৭.কর্মসূচীর সম্প্রসারণের মাধ্যমে অধিক জনগণকে এ কাজে উৎসাহিত করে তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে সহায়তা করা যেতে পারে।

গরু মোটাতাজাকরণের সুবিধা সমূহ
১। কম মূলধণ ও কম জায়গার প্রয়োজন হয়।
২। অল্প সময়ের (৪-৬ মাসের) মধ্যে গরু মোটাতাজা করে অধিক মূল্যে বাজারে বিক্রয় করা যায় অর্থাৎ আর্থিক মুনাফা অর্জন করা যায়।       
৩। খুব সল্প সময়ের মধ্যে লাভসহ মুনাফা ফেরত পাওয়া যায়।
৪। বেকার এবং মহিলাদের কর্মসংস্থানে সুযোগ বেশি।
৫। বসতভিটা আছে এমন সকল পরিবার স্বল্প বিনিয়োগকরে এ প্রকল্পের আওতায় আসার ব্যাপক সুযোগ লাভ করতে পারে।
৬। বাজারের মাংসের চাহিদা সব সময় বেশি থাকার কারণে বাজার দর নিম্নগতির সম্ভাবনা কম ও লোকসানের ঝুঁকি কম থাকে।
৭। বাড়ন্ত গরুর রোগ-ব্যাধির প্রকোপ খুব কম থাকে, ফলে আর্থিক ক্ষতির সম্ভবনা খুব কম।
৮। স্থানীয় বাজার-হাট থেকে অনায়াসে পশু ক্রয় করে প্রকল্প শুরু করা যায়।
৯। স্থানীয় ভাবে খাদ্যের সাথে বাড়ীর উচ্ছিষ্ঠ খাদ্যের সদ্ব্যাবহার হয়।

২২.২ খামার পরিকল্পনা
বীফ ফ্যাটেনিং প্রকল্পে খামার পরিকল্পনা একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। নিম্নে খামার পরিকল্পনার বিভিন্ন বিষয় আলোচনা করা হলো।
১। ব্যাক্তিগত প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা
·        গরু মোটাতাজাকরণ বিষয়ে নিজস্ব চিন্তাভাবনা।
·        খামার স্থাপন বিষয়ে আগ্রহ ও আন্তরিকতা।
·        প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা।
·        খামার পরিচালনা বিষয়ে নিজস্ব দক্ষতা।
·        সম্পদের প্রাপ্যতা।
·        খামার স্থাপনের জন্য নিজস্ব জমি।
·        নিজস্ব মূলধন অথবা মূলধন প্রাপ্তির উৎস।
·        খামার পরিচালনার জন্য সময় প্রদান।
·        ব্যবস্থাপনা/পরিচালনার জন্য বিশ্বস্ত ও দক্ষ কর্মী।
২। উপকরণ প্রাপ্তির নিশ্চয়তা
·        গরু প্রাপ্তির উৎস
·        খামারের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম
·        খাদ্য সামগ্রীর উৎস ও প্রাপ্যতা।

৩। বাজারের নিশ্চয়তা
·        উৎপাদিত গরুর জন্য স্থানীয় বাজার
·        মাংসের স্থানীয় চাহিদা অথবা বিপননের বিকল্প ব্যবস্থা
·        স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে গরুর মাংস ক্রয়ের পরিমাণ
·        মাংসের বিক্রয় মূল্য।
৪। সুযোগ সুবিধা
·        খামার স্থাপনের জন্য পরিবেশ
·        আবর্জনা ও বর্জ্য অপসারণ সুবিধা
·        সেনিটেশন সুবিধা
·        বৃহদাকার খামার হলে খামারে নিয়োজিত ব্যক্তিদের আবাসিক সুবিধা ও যানবাহন।
৫। স্থান
·        ছোট খামার হলে বসত বাড়ীর নিকট, অন্যথায় অন্যান্য খামার থেকে যথা সম্ভব দূরে
·        লোকালয় থেকে সম্ভাব্য দূরে
·        ভাল যোগাযোগ ব্যবস্থা
·        বৈদ্যুতিক সুবিধা
·        উঁচু স্থান যেখানে জলাবদ্ধতা সৃষ্টির সম্ভাবনা নেই
৬। প্রকল্প প্রণয়ন
·        খামার স্থাপনের জন্য স্থানীয় পশুসম্পদ কর্মকর্তা ও প্রয়োজনে ঋণদান সংস্থার সাথে যোগাযোগ করে প্রকল্প করতে হবে।
·        খামার স্থাপনের জন্য একটি নকশা প্রস্ত্তত করার প্রয়োজন হবে।
·        নকশার মধ্যে বিভিন্ন প্রকার ঘরের অবস্থান, চারণভূমি, ঘাস উৎপাদনের জমি এবং ভবিষ্যত সম্প্রসারণ সুবিধা দেখাতে হবে।
·        পরিবেশ দূষণ সম্ভবনা থাকলে কিভাবে নিবারণ  করা যাবে, প্রকল্পের মধ্যে তার কথা উল্লেখ থাকতে হবে।
৭। খামার প্রকল্প গ্রহণ পূর্ব বিবেচনা
গরু মোটাতাজা করার পূর্বে নিম্নের আলোচিত বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হবেঃ
ক)মূলধনঃ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে কত টাকা লাগবে এবং এর কি উৎস হতে পারে, তা পূর্বেই ঠিক করতে হবে। কারণ মূলধন পুরোপুরি সংগ্রহ না করে কাজ শুরু করলে প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্থ হবার সম্ভাবনা থাকে।
গরু বিক্রয়ের হাটঃ সাধারণত হাট-বাজার থাকলেই মোটাতাজা গরু বিক্রয়ের হাট আছে বুঝায় না। এলাকায় কতটি স্থানে কতটি গরু প্রতিদিন/প্রতি সপ্তাহে জবাই করা করা হয় তা একটি জরীপের মাধ্যমে জানতে হবে  এবং ক্রেতারা কি পরিমাণ গরুর মাংস খায়, সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ কত দরে গরুর মাংস বিক্রয় হয় তাও জানতে হবে। গরুটি বিক্রয়ের জন্য হাটে যেতে হবে নাকি কসাই এসে নিয়ে যাবে সে সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে।
গবাদিপশুর খাদ্য সামগ্রীর প্রাপ্যতাঃ গবাদিপশুর যে সকল খাদ্য দ্রব্য দরকার তা সম্পর্কে যেমন পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে তেমনি খাদ্য দ্রব্যগুলি কোথায়, কতদূরে এবং কত দরে সংগ্রহ করা যাবে তা জানতে হবে। বছরের সব সময় পাওয়া যাবে কিনা এবং একবারে কিনে রাখার মত পরিমাণ পাওয়া যাবে কিনা তা জানতে হবে।
কর্মী ও কর্মী ব্যবস্থাপনাঃ প্রকল্প সঠিক বাস্তবায়নের জন্য দুই বা দুই এর অধিক ব্যক্তির সমন্বয়ে একটি কর্মীব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। প্রত্যেক ব্যক্তির কাজের সাথে অপরের সমন্বয় থাকা জরুরি। কর্মীদের হতে হবে- সৎ, নিবেদিত, দায়িত্ববান, বুদ্ধিমান, সহানুভূতিশীল, পূর্বে এ কাজ বা অনুরূপ কাজের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন।

২২.৩ গরু মোটাতাজাকরণের জন্য অত্যাবশ্যকীয় পদক্ষেপসমূহ
বাণিজ্যিকভাবে গরু মোটাতাজাকরণের জন্য কমপক্ষে ১২টি অত্যাবশ্যকীয় পদক্ষেপসমূহের প্রতি বিশেষভাবে নজর দিতে হয়ঃ
1.      প্রকল্প চালুর উপযুক্ত সময়।
2.     সঠিক জাতের গবাদি পশু নির্বাচন ও ক্রয়।
3.    বিভিন্ন পশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা নিশ্চিত করণ।
4.      বিভিন্ন রোগের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন বা প্রতিষেধক প্রদান
5.     গবাদি পশুর স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থানের ব্যবস্থা করণ।
6.     সুষম ও পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্য সরবরাহ ও নিশ্চিত করণ।
7.     পশুর দৈহিক ওজন রেকর্ড করণ
8.     পশুর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা
9.     এঁড়ে গরু খোঁজা করণ
10. মোটাতাজাকরণ প্রকল্পের জন্য মেয়াদকাল।
11.  বাজারজাতকরণের উপযুক্ত সময় নির্ধারণ।
12. গরু মোটাতাজাকরণ প্রকল্পে বিনিয়োগ ও মুনাফার তথ্য রেকর্ডকরণ।

২২.৩.১ । প্রকল্প চালুর উপযুক্ত সময়
আমাদের দেশের আবহাওয়ায় যে কোন সময় এ প্রকল্প শুরু করা যায়। তবে আমাদের দেশে ঈদুল আজহার সময় গবাদি পশুর ব্যাপক চাহিদা থাকে। এই উৎসবে যাতে পশু বিক্রয় করা যায় সেই অনুপাতে প্রকল্প শুরু করতে হবে অর্থাৎ উৎসবের ৪/৫ মাস পূর্বে প্রকল্প চালু করা যেতে পারে। এছাড়া যে সময় গবাদি পশুর দাম কম থাকে এবং পশু খাদ্য পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যায় সেই সময় প্রকল্প শুরু করা যায়। যে সময়ে পশুর দাম চড়া ও খাদ্যাভাব এবং রোগের প্রকোপ বেশি সেই সময় প্রকল্প হাতে নেওয়া যাবে না। তবে নভেম্বর/ডিসেম্বর মাসে আরম্ভ করলে ভাল হয়। কারণ, এ সময় একটু ঠান্ডা থাকে ফলে গবাদিপশুকে এক স্থান হতে ক্রয় করে অন্য স্থানে সহজেই পরিবহন করা সহজ হয় এবং পশু নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে। প্রকল্প চালুর উপযুক্ত সময় নির্ভর করবে যেখানে খামার করা হবে সেখানকার আবহাওয়া, গরু ও খাদ্যের বাজার দর ইত্যাদি।
২২.৩.২। পশু নির্বাচন ও ক্রয়
উপযুক্ত জাত ও ধরন অনুসারে পশু নির্বাচন এবং ক্রয়ের ক্ষেত্রে নিম্নবর্ণিত বিষয়সমূহ অনুসরণ করতে হবে।
ক) পশুর বয়সঃ মোটাতাজাকরণ বা বীফ ফ্যাটেনিং কর্মসূচীর জন্য ২.৫-৪ বৎসরের এঁড়ে/ষাড় গরু ক্রয় করা উচিত। যদিও এঁড়ে বাছুরের বয়স নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। কেউ কেউ এঁড়ে বাছুরের বয়স ১.৫-২ বছর হওয়া উচিত বলে মনে করেন। তবে এই বয়সের পশু প্রচুর খেতে পারে না এবং খেলেও হজম করতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে এ বয়সের ষাঁড় গরুর শরীর ঠিকমত বাড়তে ৫/৬ মাস লেগে যায়। এজন্য ২ বছরের উর্দ্ধে এমন পশু হলেই ভাল হয়। সাধারণত ২-৪ বছরের সংকর জাতের ষাঁড় গরুর বৃদ্ধির হার অন্যান্য বয়সের তুলনায় বেশী হওয়ায় মোটাতাজাকরণের ক্ষেত্রে এ ধরনের বয়সের পশু নির্বাচন করতে হয়।
 পশুর বয়স নির্ণয় পদ্ধতিঃ গবাদিপশুর বয়স ফার্ম থেকে ক্রয় করলে ফামের্র রেজিষ্টার হতে পাওয়া যায়। এছাড়া পশু মালিকের নিকট থেকে তথ্য নিয়ে জানা যায়। বাছুর গরুর জন্মগ্রহণের রেজিষ্টার সংরক্ষিত না থাকলে পশুর দাঁত ও শিং এর রিং দেখে বয়স নির্ণয় করা যায়। গবাদিপশুর যখন দুটি স্থায়ী ইনসিজর দাঁত ওঠে তখন পশুটির বয়স হবে ১৯-২৪ মাস অর্থাৎ গরুর বয়স ২ বছর। এর পর প্রতি ৬ মাস অন্তর অন্তর এক জোড়া করে স্থায়ী দাঁত উঠে। একটি ৩.৫-৪.০ বছরের গরুর সামনের নিচের পাটিতে প্রতি পার্শ্বে ৪টি করে মোট ৮টি দাঁত উঠবে। গরুর বাচ্চা ভূমিষ্ট হওয়ার সময় অথবা বাছুরের ১ সপ্তাহ বয়সে সামনের অস্থায়ী দাঁত গজায় এবং ৫-৬ মাসের মধ্যে অস্থায়ী দাঁত সবগুলো উঠে যায়। অস্থায়ী ও স্থায়ী দাঁতের মধ্যে পার্থক্য হলো দাঁতগুলো কিছুটা সরু, দুই দাঁতের মাঝে ফাঁকা থাকবে এবং স্থায়ী দাঁত মোটা হয়ে ওঠবে এবং দুই দাঁতের গোড়ায় কোন ফাঁকা থাকবে না। এছাড়া শিং দেখে বয়স নির্ণয়ের বিষয়টি আরো সহজ। এ ক্ষেত্রে শিং এ গোলাকার রিং দেখে বয়স নিরুপন করা হয়। প্রতি রিংয়ের সংখ্যা +২ = পশুর প্রকৃত বয়স।
এছাড়া বলদ গরুকে মোটাতাজাকরণের প্রকল্পের জন্য ক্রয় করে দেখা গেছে বলদের স্বাস্থ্য তাড়াতাড়ি বৃদ্ধি হয় এতে অনেক প্রকল্প গ্রহণকারীগণ এড়ে গরুর চেয়ে বেশি লাভবান হয়েছেন।
(খ) মোটাতাজাকরণের জন্য জাত বাছাই
পশু নির্বাচনে গরুর জাত একটি গরুত্ব পূর্ণ বিষয়। Beef Fatteningএর জন্য আমাদের দেশে মাংসল কোন পৃথক গরুর জাত নেই। গরু মোটাতাজাকরণের জন্য উন্নত দেশে  মাংসল জাত ব্যবহার হয়। উন্নত দেশে বিভিন্ন ধরনের মাংসের জন্য পৃথক জাতগুলো হলোঃ  এবারডিন, এ্যানগাস, বীফমাষ্টার ও হেরিফোর্ড ডেভন ইত্যাদি
যেহেতু আমাদের দেশে মাংসের জন্য পৃথক কোন জাত নাই সুতরাং দেশে প্রাপ্ত গরু-বাছুর বা সংকর জাতের পশু বিশেষভাবে মুল্যায়ন (Individual Performences)করে যাচাই-বাছাই করা উচিত এবং যে সময় গরুর বাজার দর কম থাকে সে সময়ে ক্রয় করা উচিত। গরু মোটাতাজা করার জন্য দেশী জাতের ষাঁড়, শাহীওয়াল সংকর ও ফ্রিজিয়ান সংকর জাতের ষাঁড় ক্রয় করা বাঞ্ছনীয়।

গবাদি পশু ক্রয় করার সময় নিম্নবর্ণিত বৈশিষ্ট্যগুলো বিচার করে সতর্কতার সহিত পশু নির্বাচন করতে হবে।

বৈশিষ্ট্যাবলীঃ
১.পশুটির পূর্ব বংশ ভাল কিনা তা ভাল করে জেনে নিন।
২. মাথা ও গলা খাটো এবং চওড়া হতে হবে।
৩. কপাল প্রশস্ত হওয়া আবশ্যক।
৪. গায়ের চামড়া ঢিলে ঢালা হওয়া উচিৎ।
৫ .কাঁধ খুব পুরু ও মসৃন।
৬. পিঠ চ্যাপ্টা, অনেকটা সমতল।
৭. কোমরের দুই পার্শ্ব প্রশস্ত ও পুরু।
৮. বুক প্রশস্ত ও বিস্তৃত হতে হবে।
৯. শরীরে হাড়ের আকার মোটা  হতে হবে।
১০. সামনে পা দুটো খাটো ও শক্ত সামর্থ হতে হবে।
১১. শিং খাটো ও মোটা হওয়া বাঞ্চনীয়।
১২. এঁড়ে/বলদ গরু হওয়া বাঞ্চনীয়।
১৩. লেজ খাটো হতে হবে।
১৪. স্বাভাবিক ভাবে পশুটি শারিরীক রোগ ক্রটি মুক্ত হতে হবে (খোড়া, গায়ে ঘা, অন্ধ, শরীরে টিউমার, রক্তশূন্যতা ইত্যাদি)।
১৫. স্বাভাবিক ভাবে দাঁড়ানো অবস্থায় পশুটিকে এশটি আয়তক্ষেত্রের মত হতে হবে।
১৬. বদমেজাজী গরু ক্রয় করা উচিত নয়। (মানুষ দেখলে গুতো দেওয়া অভ্যাস)।

চিত্র ২২.১


গরু ক্রয়ের উৎসঃগরু ক্রয়ের উৎস আগে থেকে ঠিক করতে হবে। যেমন-কোন ফার্ম থেকে সংকর জাতের শুধু ষাঁড় বাছুর সংগ্রহ করা যেতে পারে। স্থানীয় কোন বাজার থেকেও দেশী বা সংকর জাতের ষাঁড় গরু ক্রয় করা যেতে পারে গরু ক্রয়ের পর পরিবহণ একটি সমস্যা হতে পারে দু তিন কিলোমিটার পথ হলে গরুকে হাঁটিয়ে নিয়ে আসা যেতে পারে দূরের পথ হলে অবশ্যই পরিবহণ ব্যবহার করতে হবে এবং সে খরচ পোষাতে হলে গরুর সংখ্যা বেশি হতে হবে। গরুকে বেশি হাঁটিয়ে নিলে যে পরিশ্রম হবে তা কাটিয়ে উঠতে সময় নিবে এবং খরচও বেশি হবে।

২২.৩.৩ নির্বাচিত পশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও চিকিৎসা

১. গরুগুলো কোন রোগে আক্রান্ত কিনা তা ভালোভাবে পরীক্ষা করে সুষ্ঠু চিকিৎসা করে সুস্থ করে তুলতে হবে।
২. পশুকে ডি-ওয়ামিং এর মাধ্যমে কৃমিমুক্ত করতে হবে। কারণ আমাদের দেশের প্রায় ১০০% পশু কৃমিতে আক্রান্ত হয় এ জন্য পশু ক্রয় করার পর অবশ্যই কৃমিনাশক ঔষধ প্রয়োগ করতে হবে। এর পর ঐ পশুকে ৩/৪ মাস পর পর পুনরায় কৃমিনাশক ঔষধ খাওয়াতে হবে। বাজারে বিভিন্ন ধরনের ব্রড  স্প্রেকটাম কৃমিনাশক ঔষধ পাওয়া যায়।

বিভিন্নি রোগের বিরুদ্ধে টীকা/প্রতিষেধক

গরুকে কোন টিকা দেওয়া না থাকলে ক্রয় করার ৭ দিন পর থেকে বিভিন্ন ধরনের টিকা ১৫ দিন পর পর দিতে হবে। নিম্নে বর্ণিত টিকা পশুকে প্রয়োগ করতে হয় যেমন- তড়কা, ক্ষুরা, বাদলা, গলাফুলা ইত্যাদি।
প্রকল্পের গরুকে কমপক্ষে ২টি ভ্যাকসিন অবশ্যই করা উচিত। একটি হল তড়কা  রোগ ও অপরটি হলো ক্ষুরা বা F.M.Dরোগের টিকা। কারণ তড়কা একটি মারাত্মক রোগ। তড়কা টিকা প্রদান না করলে যে কোন সময় পশু মারা যেতে পারে। এ রোগ হলে চিকিৎসার সুযোগ দেয় না। তড়কা রোগের ভ্যাকসিন ১ মিলি চামড়ার নীচে দিতে হবে বছরে একবার মাত্র।
এছাড়া ক্ষুরা F.M.Dরোগ ও  একটি মারাত্মক রোগ যদিও এ রোগে বড় পশু মারা যায় না তথাপি এ রোগে পশুর ওজন এত কমে যায় অর্থাৎ দুর্বল হয়ে পড়ে যে ৬ মাসে সেই পূর্বের অবস্থায় পশুর স্বাস্থ্য ফিরে আসে না এবং শরীরে ৬ মাস পর্যন্ত এ রোগের জীবাণু বসবাস করে। তাই তড়কা ভ্যাকসিন দেয়ার ১০-১৬ দিন পর F.M.Dভ্যাকসিন দিতে হবে। F.M.D  ভ্যাকসিন বিভিন্ন স্ট্রেন মিশ্রণে হয় তাই প্রস্তত কারকের নির্দেশ মোতাবেক যেমন সরকারী মহাখালী পশু সম্পদ গবেষণাগার হতে তৈরি ভ্যাকসিন ১টি স্ট্রেন দ্বারা হলে ৩ সিসি ২টি স্ট্রেন দ্বারা তৈরি হলে ৬ সিসি চামড়ার নীচে দিতে হবে। এছাড়া F.M.D Vaccine   বিদেশী হলে স্ট্রেন ও প্রস্ত্তত কারকের নির্দেশ মোতাবেক এটি সাধারণত ৫ সিসি বা ২ সিসি চামড়ার নীচে দিতে হয়। F.M.Dভ্যাকসিন প্রতি ৪ মাস পর পর দেওয়ার নিয়ম।
উল্লেখিত ২টি ভ্যাকসিন প্রয়োগ করলে গরু মোটাতাজাকরণের পশু সংক্রামক রোগের হাত হতে মোটামুটি রক্ষা পাবে। তবে সুযোগ থাকলে বাদলা ও গলাফুলা রোগের টিকা প্রয়োগ করতে হবে।

২২.৩.৪ স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থান
গরুর বাসস্থানের উদ্দেশ্য
1.      বিভিন্ন প্রতিকুল অবস্থা থেকে রক্ষা করা
2.     বিভিন্ন বন্য প্রাণী এবং চোর ও দুষ্কৃতিকারীদের উপদ্রব থেকে রক্ষা করা
3.    আরামদায়ক পরিবেশে বাসের সুযোগ প্রদান
4.      স্বাস্থ্য সম্মত ব্যবস্থা গ্রহণ
5.     সহজে পরিচর্যা করার সুবিধা
6.     সহজে খাদ্য প্রদানের সুবিধা 


খামারে প্রয়োজনীয় ঘর

1.     গরুর ঘর

2.    রোগাক্রান্ত গরুর আলাদা ঘর

3.    কর্মচারী/পরিচর্যাকারীর ঘর।

ঘরের প্রকার
1.      উম্মুক্ত ঘর এবং
2.     প্রচলিত ঘর
উম্মুক্ত ঘরের বিবরণ
* এই ঘর চারিদিকে শক্ত কাঠ অথবা লোহার পাইপ দ্বারা ঘেরা থাকে
* ঘেরার মধ্যে গরু ছাড়া অবস্থায়  থাকে
* ঘেরার বাইরে পাত্রে খাবার দেওয়া হয়
* ঘেরার ভিতর দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে তারা খাদ্য খেতে পারে এবং পাত্রে দেওয়া পানি পান করতে পারে।
* ঘেরার মধ্যে তাদের স্বতন্ত্র বিশ্রামের জন্য নির্দিষ্ট স্থান থাকে
* ঘেরার মধ্যে পশু স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে পারে
* সকালে-বিকালে ঘেরার ভিতরের গোবর পরিষ্কার করে হোস পাইপের সাহায্যে ধুয়ে দেওয়া হয়।
* কখনও একই ঘরের মধ্যে বিপরীত লিংঙ্গের গবাদি পশু একত্রে রাখা হয় না
* এই প্রকারের ঘরের শুধু ছাউনি থাকে এবং চারিদিকে খোলামেলা থাকে। ঝড়-বৃষ্টি ও শীতের সময় চারিদিকে চটের পর্দা ঝুলিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা থাকে
* উন্মুক্ত ঘরে গরু প্রতি ৮-৯ বর্গমিটার স্থান বা ৮৫-৯৫ বর্গফুট স্থান প্রয়োজন
* ষাঁড় গরু এই জাতীয় ঘরে রাখা কিছুটা সমস্যা হয়।

চিত্র ২২.২

প্রচলিত ঘরের বিবরণ
* এই প্রকার ঘরে গরু বাঁধা অবস্থায় পালন করা হয়
* ঘরের মধ্যে গরু ১ বা ২ সারিতে অবস্থান করে
* প্রতি গরুর জন্য স্বতন্ত্র থাকার ব্যবস্থা কাঠ অথবা লোহার রড দ্বারা পৃথক করা থাকে
* সম্মুখে লম্বা ম্যানজার বা খাদ্যপাত্রে খাদ্য প্রদান করা হয়
* খাদ্য পাত্রের পাশে বালতিতে অথবা স্বতন্ত্র স্বয়ংক্রিয় অবস্থায় পানি প্রদানের ব্যবস্থা থাকে
* ম্যানজার সিমেন্ট, সুরকী, বালি দ্বারা ঢালাই করে প্রস্ত্তত করা হয়
* গরু প্রবেশ পথের (এবং পরিচর্যাকারীর চলাচল পথের) উভয় দিকে ড্রেন থাকে
* প্রতিদিন সকালে বিকালে ড্রেনের গোবর ও চনা পরিষ্কার করতে হয়
* দুই সারিতে অবস্থানকারী গরুর ঘর আবার ২ প্রকৃতির অন্তর্মুখী এবং বহির্মুখী সারি বিশিষ্ট।

অন্তর্মুখী সারি বিশিষ্ট ঘর
* এই ঘরে গরু মুখোমুখি অবস্থায় অবস্থান করে
* উভয় সারির সম্মুখ খাদ্য দেওয়ার জন্য ম্যানজার থাকে
* উভয় সারির ম্যানজারের মধ্য বরাবর পরিচর্যা ও খাদ্য প্রদানের জন্য পরিচর্যাকারী চলাচলের রাস্তা থাকে
* পরিচর্যাকারীর একই সাথে উভয় সারিতে খাদ্য পরিবেশন করতে পারে
* গরুর পিছন দিক বহির্মুখী থাকে
* গরুর পিছন বরাবর ড্রেন থাকে।
* প্রতিদিন ড্রেনের মধ্য থেকে গোবর ও চনা পরিষ্কার করতে হয়।
বহির্মুখী সারি বিশিষ্ট ঘর
* এই ঘরে গরু বিপরীত মুখী অবস্থায় অবস্থান করে।
* এই পদ্ধতিকে Tail to tailপদ্ধতি বলে
* উভয় সারির মাঝখানে চলাচল পথ থাকে এবং রাস্তার ও দুই পার্শ্বে ড্রেন থাকে।
* দুই সারি গরুর সামনে খাবার পাত্র ও চলার পথ থাকে
* এই পদ্ধতিতে গরু মুক্ত বাতাস পায়।
* গরুর পিছন দিক অন্তর্মুখী থাকে।
* এই রাস্তায় যাতায়াত করে গোবর সহজে পরিষ্কার করা যায়।

গরু মোটাতাজাকরণ প্রক্রিয়ায় গবাদি পশুকে আবদ্ধ অবস্থায় পালন করতে হয়। তাই এদের বাসস্থান উত্তম ও সঠিক হওয়া বাঞ্ছনীয়। যেখানে পালন করা হয় সেই সমস্ত জায়গায় ও আশপাশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। পানি ও বৃষ্টির পানি যাতে গড়িয়ে চলে যায় সেই জন্য বাসস্থান সামান্য ঢালু প্রকৃতির হলে ভাল হয়। প্রতি গরুর জন্য ২০ বর্গফুট (৫র্×৪র্) জায়গা প্রয়োজন।
৪টি গরুর জন্য সর্বমোট ৮০ বর্গফুট (৫র্×৪র্×৪র্) জায়গার প্রয়োজন হয়। গোয়াল ঘরে গরু গুলোকে এক সারি বা ২ সারিতে রাখা যেতে পারে। গরু দাঁড়ানোর সম্মুখে খাবার চাড়ি/মেঞ্জার রাখতে হবে এরং খাবার দেওয়ার পথ থাকতে হবে এবং মেঝে পিছনের দিকে ঢালু রাখতে হবে যাতে প্রস্রাব-পায়খানা গড়ে পিছনের দিকে ড্রেনের মাধ্যমে সহজেই চলে যেতে পারে। এতে ঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকবে। ঘরের উপরের চালা অল্প খরচে করাই ভাল যেমন ছাউনিতে খড়/ছন (ঘর ঠান্ডা থাকবে) অথবা ঢেউটিন দেওয়া যেতে পারে। টিন দিলে টিনের নীচে চাটাই দিতে হবে এতে ঘর ঠান্ডা থাকবে এবং শীতকালে কুয়াশার হাত থেকে রক্ষা করবে। ঘরের উচ্চতা ৭-১০ ফিট হতে হবে। উক্ত উচ্চতা বিশিষ্ট ঘরের দেওয়াল ৩ অংশ খোলা থাকবে । যাতে ঘরে পর্যাপ্ত পরিমাণ আলো-বাতাস পায়। ফলে রোগ জীবাণুর প্রকোপ কম হবে। ঘর উত্তর-দক্ষিণ মুখী হলে ভাল হয়। ঘরের দেওয়ালের বেড়া ইটের হতে হবে। বাকী ফাঁকা অংশ খুপড়ী বেড়ার মত করা যেতে পারে। তবে অত্যাধিক শীতের/বৃষ্টির সময় ফাঁকা অংশ চট দিয়ে ঢেকে দিতে হবে যাতে পশু শীতে/পানিতে ভিজে কষ্ট না পায়। ঘরের মেঝে পাকা বা ইট বিছানো হতে হবে।

২৩.৩.৫ খাদ্য ব্যস্থাপনা
বীফ ফ্যাটেনিং প্রকল্পে গবাদি পশুর জন্য পরিমাণমত সুষম খাদ্য সরবরাহ সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। খাবারের তালিকায় শর্করা, আমিষ, চর্বি ও ভিটামিন এর পরিমাণ সাধারণতঃ খাদ্যের চেয়ে বেশি থাকতে হবে। প্রচুর পরিমাণ টিউবলের টাটকা পানি সরবরাহ করা প্রয়োজন। আমাদের দেশে গবাদি পশুর সবচেয়ে সহজলভ্য ও সাধারণ খাদ্য হল খড় যার ভিতর আমিষ, শর্করা ও খনিজের ব্যাপক অভাব রয়েছে। বর্তমানে আধুনিক যুগে খড়কে ইউরিয়া দ্বারা প্রক্রিয়াজাত করলে তার খাদ্যমান বহুগুনে বেড়ে যায়। তাই অতি অল্প খরচে একটি সুনির্দিষ্ট নিয়মে ইউরিয়া ও চিটাগুড় মিশ্রিত খড় (ইউরিয়া মোলাসেস স্ট্র) খাইয়ে গরুকে মোটাতাজা করা যায়। গরু মোটাতাজা করণের জন্য খাদ্যে ইউরিয়ার ব্যবহার একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার ও আধুনিক পন্থা। গরুকে মোটাতাজা করণের জন্য ইউরিয়া দ্বারা তৈরি যেমন ইউ.এম.এস বা ইউরিয়া মোলাসেস স্ট্র, ইউরিয়া প্রক্রিয়াজাত খড়, মোলাসেস ব্লক, সরাসরি ইউরিয়া যে কোন একটি খাওয়ালেই চলবে।
গরু মোটাতাজাকরণে কেন ইউরিয়া খাওয়াবেন?
ইউরিয়া এক ধরনের রাসায়নিক সার। আমাদের দেশের পশু খাদ্যে আমিষের পরিমাণ খুব কম, কিন্তু দ্রুত বৃদ্ধিতে আমিষের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। পশুকে যে খড় আমরা খাওয়াই তাতে খুব সামান্য পরিমাণ আমিষ জাতীয় খাদ্য আছে। পক্ষান্তরে ইউরিয়া সারে ২৪৫% ক্রুড আমিষ আছে। স্বল্পমূল্যে খড়ে উচ্চ ক্ষমতাপূর্ণ আমিষের সঙ্গে মিশিয়ে খড়ে আমিষের পরিমাণ অনেকাংশে বাড়ানো যায়। এ ধরনের ইউরিয়া প্রক্রিয়াজাত খড় পশু খেলে হঠাৎ করে শরীর বৃদ্ধি হয় এবং পশুর শরীর বাড়তে থাকে। এই জন্য পশুর স্বাস্থ্য গরু মোটাতাজাকরণ প্রকল্প বৃদ্ধির জন্য ইউরিয়া ব্যবহার অত্যাবশ্যক, কারণ ইউরিয়া দ্রুত মাংস  বাড়ায়।
পশু মোটাতাজাকরণের জন্য সরাসরি ইউরিয়া খাওয়ার পদ্ধতি
ইউ.এম.এম. ইউরিয়া প্রক্রিয়াজাত খড় ও মোলাসেস ব্লক ইত্যাদি যে কোন একটি খাওয়ানো গরু মোটাতাজাকরণের জন্য অত্যাবশ্যক। তবে সরাসরি ইউরিয়া খাওয়ালেও পশুকে মোটাতাজাকরণে সুফল পাওয়া যায়। এই জন্য পশুকে প্রথম ১৫ দিন ১ চা চামচ বা ৫ গ্রাম ইউরিয়া ২০০ মিলি গ্রাম চিটাগুড়ের সংগে মিশিয়ে তা ১.৫-২ লিটার পানির সংগে মিশিয়ে টুকরা টুকরা করে কাটা খড়ের সংগে মিশিয়ে খাওয়ানো যায়। ১৫ দিন পর শুধু ইউরিয়ার পরিমাণ ৫ গ্রাম বৃদ্ধি করে মোট ১০ গ্রাম বা ২ চা চামচ একই পরিমাণ চিটাগুড়ের সংগে পরিমাণ মত কাটা খড়ের/ঘাসের সংগে মিশিয়ে এবং পরবর্তী ১৫ দিন পরও আরও ৫ গ্রাম বৃদ্ধি করে অর্থাৎ ১৫ গ্রাম বা ৩ চা চামচ একই নিয়মে খাওয়ানো যায়। পরবর্তী ১৫ দিন পরও আর ৫ গ্রাম মোট ২০ গ্রাম বা ৪ চা চামচ ইউরিয়া খাওয়াতে হবে। প্রতিদিন ২০ গ্রাম বা ৪ চা চামচের বেশি ইউরিয়া খাওয়ানো যাবে না। এইভাবে সরাসরি ইউরিয়া খাওয়ানোর ৩-৪ মাসের মধ্যে পশুর শরীরের মাংস বেড়ে যাবে।
সাবধানতা
১। কোনক্রমেই ২০ গ্রাম/৪ চা চামচ এর বেশি ইউরিয়া পশুকে দেওয়া যাবে না।
২। ছয় মাসের নিচের পশুকে খাওয়ানো যাবে না।
৩। অবশ্য চিটাগুড় ২০০-২৫০ মিলি গ্রাম ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
৪। শুকনা খড়ের সংগে খাওয়াতে হবে।
৫। প্রথম বার বা হঠাৎ করে ২০ গ্রাম ইউরিয়া খাওয়ানো যাবে না। কারণ, এতে পশুর বদহজম হতে পারে এমনকি বিষ ক্রিয়ায় পশু মারা যেতে পারে। তাই ৫ গ্রাম থেকে শুরু করে আস্তে আস্তে বৃদ্ধি করে সর্বোচ্চ ২০ গ্রাম খাওয়ানো যায়।
পশু খাদ্য প্রস্ত্ততের শর্তাবলী
১। খাদ্য সুষম হতে হবে
২। সহজপাচ্য হতে হবে
৩। গরুর জন্য পছন্দনীয় হতে হবে
৪। দাম তুলনামূলক কম হতে হবে
৫। ভেজাল বা ধুলাবালিমুক্ত হতে হবে ।
পশু খাদ্য মজুদ প্রণালী
কিছু খাদ্য আছে যা সারা বছর পাওয়া যায় না, যা মৌসুমে মজুদ করলে কম দামে পাওয়া যায়। যেমন ঘাস, খড়, খৈল, ডালের ভূষি ইত্যাদি।
খাদ্য যত কম দামে ক্রয় করা যাবে গরু মোটাতাজাকরণ প্রকল্পে লাভ তত বেশি হবে।
কিকি খাদ্য মজুদ করতে হবেঃ মৌসুম ভিত্তিক, খড়,কাঁচা ঘাস,শস্যদানা যেমন গম ,ভুট্টা বা যে কোন ডাল ,খৈল
খাদ্য মজুদ করার ক্ষেত্রে কিছু সাবধানতাঃমজুদের ঘর অবশ্যই মাঁচাযুক্ত হতে হবে।
·        গমের ভূষি অবশ্যই শুকনা হতে হবে
·         কুড়া ২ মাসের বেশি মজুদ করলে ছত্রাক পড়তে পারে। সেক্ষেত্রে ২ মাস পর পর মজুদ করা যেতে পারে।
·         ডাল/কলাইর ভূষি ৪ মাস পর্যন্ত মুজদ করা যায়
·        খৈল মজুদের ক্ষেত্রে খৈলকে ভাংগিয়ে না রেখে আস্ত রাখতে হবে এতে খৈল বৎসরকাল সংরক্ষণ করা যায়।
·        ঝিনুকের গুঁড়া বৎসরকাল সংরক্ষণ করা যায়
·        ইউরিয়া যখন প্রয়োজন বস্তা ধরে কিনলেই চলবে।
·        মোলাসেস এর ক্ষেত্রে চিনিকল থেকে সারা বছরের প্রয়োজনীয় পরিমাণ মজুদ করা যেতে পারে অথবা সময়ে সময়ে ক্রয় করা যেতে পারে।
·        সকল ক্ষেত্রেই খাদ্য অবশ্যই বৃষ্টির পানিতে যেন না ভিজে সে দিকে নজর দিতে হবে। গুঁড়া জাতীয় খাদ্যের ক্ষেত্রে শুকনা নিমের পাতা বস্তার ভেতর মাঝে মাঝে কিছু দিয়ে রাখলে পোকা ধরবে না।
সুষম দানাদার খাদ্য
কুড়া, গমের ভূষি, চাউলের খুদী, খৈল, কলাই, মটর, খেশারী, শুকনা রক্ত কুড়া ইত্যাদি গরুর দানাদার খাদ্য। পশু মোটাতাজাকরণের জন্য খাদ্যে দানাদার জাতীয় খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা বেশি। বাংলাদেশে যে সমস্ত খাদ্য সচারচর পাওয়া যায় তা দ্বারা স্বল্প খরচে সুষম দানাদার খাদ্য তৈরির মডেল দেওয়া হলো।  সুষম খাদ্যের মডেল অনুসরণ করে  মোটাতাজাকরণের গরুকে নিয়মিত খাওয়ালে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাবে।

সারণী ২২.১  গরু মোটাতাজাকরণের জন্য সুষম খাদ্যের তালিকা
১ কেজি খাদ্যে কত পরিমাণ কি কি খাদ্য উপাদান থাকে তা নিম্নে দেওয়া হইল
খাদ্য উপাদান পরিমাণ
গমের ভূষি ১৭০ গ্রাম
চাউলের কুড়া (তুষ ছাড়া) ১৫০ গ্রাম
তিলের/সরিষার খৈল ২৫০ গ্রাম
চাউলের খুদ (জাউ রান্না) ১০০ গ্রাম
কলাই বা ছোলা ভাংগা (খেশারী/মাটি/কাউপি) ২০০ গ্রাম
ডিসিপি ২০ গ্রাম
লবণ ২৫ গ্রাম
ভিটামিন প্রিমিক্স ৫ গ্রাম
 মোট ১০০০ গ্রাম বা ১ কেজি

খাদ্য সরবরাহের নিয়ম
বীফ ফ্যাটেনিং বা গরু মোটাতাজাকরণের জন্য গবাদি পশুকে প্রতিদিন নিম্নবর্ণিত হারে খাদ্য সরবরাহ করা প্রয়োজন।
সারণী ২২.২ বিভিন্ন ওজনের পশুর জন্য খাদ্য সরবরাহ
পশুর বিবরণ খাদ্যের নাম
ইউএমএস বা ইউরিয়া প্রক্রিয়াজাত খড় বা শুধু খড় দানাদার খাদ্য সুষম সবুজ ঘাস
১০০ কেজির কম ওজনের জন্য ২ কেজি ২.৫-৩ কেজি ৪-৫ কেজি
১০০-১৫০ কেজি ওজনের পশুর জন্য ৩ কেজি ৩.০-৩.৫ কেজি ৭-৮ কেজি
১৫০-২০০ কেজি এবং ততউর্দ্ধ ওজনের পশুর জন্য ৪ কেজি ৪.০-৪.৫ কেজি ৮-১২ কেজি

চিত্র ২২.৩
বীফ ফ্যাটেনিং বা গরু মোটাতাজাকরণের জন্য গবাদী পশুকে খাদ্য খাওয়ানোর নির্দেশাবলী
·        পরিষ্কার ও সুষম খাদ্য খাওয়াতে হবে।
·        আশঁযুক্ত খাবার ২-৩ ইঞ্চি টুকরা করে খাওয়াতে হবে।
·        দানাদার খাবার চূর্ণবিচূর্ণ করে খাওয়াতে হবে।
·        দানাদার খাবারে ৪-৬ ভাগ চর্বি থাকতে হবে।
·        দৈহিক ওজন অনুসারে প্রয়োজনীয় খাবার একবারে না দিয়ে ২৪ ঘন্টায় ৫-৬ বারে দিলে পশুর হজম ক্রিয়া ভাল হয়।
·        খাদ্যে দানাদার, খড়, কাঁচাঘাস ও পানির অনুপাত ১ঃ৩ঃ৫ঃ১০/১৫ হতে হবে।
·        খড় খাওয়ানোর পূর্বে ২-৩ ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখলে খাদ্যের মান বাড়ে।
·        প্রাণিদেহে শতকরা ৬০-৭০ ভাগ পানি তাই ১০-১৫ ভাগ পানি সরবরাহ করতে হবে।
·        পশুদেহ যেহেতু ১৬ ভাগ আমিষ দ্বারা গঠিত সুতরাং খাদ্যে শতকরা ১৬ ভাগের বেশি আমিষ থাকতে হবে।
·        শুধুমাত্র খড় না দিয়ে এর সাথে দানাদার খাবার, ইউরিয়া, মোলাসেস, পানি কাঁচাঘাস মিশিয়ে খাওয়ালে খাদ্যের মান বৃদ্ধি হয়।
·        গরু মোটাতাজাকরণের জন্য সরিষার খৈল বেশি উপকারী।

·        পশুর বদ-হজম, পেট-ফাপা ও পাতলা পায়খানা হলে দানাদার খাদ্য খাবার দেওয়া যাবে না।
২২.৩.৬ পশুর দৈহিক ওজন রেকর্ড করণ
এই  প্রকল্পে পশুর ওজন নিয়মিত রেকর্ড করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রকল্প চালুর শুরুতে ক্রয়কৃত সবগুলো পশুর ওজন পৃথক পৃথক ভাবে রেকর্ড করতে হবে এবং ১৫ দিন পর পর প্রতিটি পশুর ওজন খাবার সরবরাহের সংগে বৃদ্ধি হচ্ছে কিনা তা যাচাই করা যায়। তাতে পালনের অগ্রগতি বুঝা যায়। প্রকৃত পশুর ওজন নির্ণয় করার জন্য ব্যাল্যান্স ব্যবহার করাই উত্তম । তবে সহজ ১টি ফরমুলাতে পশুর ওজন বের করা যায়। তবে পশুর সঠিক ওজনের কাছাকাছি ফলাফল পাওয়া যায়। ক্লথ টেপের সাহায্যে পশুর দৈর্ঘ্য ও বুকের মাপ নেওয়া হয়।
পশুর দৈর্ঘ্য= পশুর লেজের উপরের পিন পয়েন্ট থেকে অথবা পাছার উঁচু হাড় হতে সোল্ডর পয়েন্ট বা গলার মাঝ বরাবর পর্যন্ত।
বুকের বেড়= সামনের ২ পায়ের ঠিক পিছনের দিক বরাবর
এছাড়াও গবাদিপশুর বুকের বেড় থেকে তাদের দৈহিক ওজন নির্ণয় করা যায়।
নিচে তালিকা দেয়া হল
সারণী ২২.৩ঃ গবাদিপশুর বুকের বেড় থেকে তাদের দৈহিক ওজন নির্ণয়
বুকের বেড় (ইঞ্চি) দৈহিক ওজন (কেজি) বুকের বেড় (ইঞ্চি) দৈহিক ওজন (কেজি) বুকের বেড় (ইঞ্চি) দৈহিক ওজন (কেজি)
২৫ ১৯ ৩৯ ৬৪ ৫৩ ১৬২
২৬ ২০ ৪০ ৬৯ ৫৪ ১৭১
২৭ ২১ ৪১ ৭৩ ৫৫ ১৮১
২৮ ২৩ ৪২ ৭৮ ৫৬ ১৯১
২৯ ২৫ ৪৩ ৮৩ ৫৭ ২০০
৩০ ২৭ ৪৪ ৮৭ ৫৮ ২১০
৩১ ৩০ ৪৫ ৯২ ৫৯ ২১৯
৩২ ৩২ ৪৬ ৯৬ ৬০ ২২৯
৩৩ ৩৫ ৪৭ ১০১ ৬১ ২৩৪
৩৪ ৩৯ ৪৮ ১১৩ ৬২ ২৪৭
৩৫ ৪৩ ৪৯ ১২৩ ৬৩ ২৫৬
৩৬ ৪৯ ৫০ ১৩৩ ৬৪ ২৬৫
৩৭ ৫৪ ৫১ ১৪৩ ৬৫ ২৭৫
৩৮ ৫৯ ৫২ ১৫২ ৬৬ ২৮৬

পশুর ওজন রেকর্ড এর মাধ্যমে ঐ পশুর দৈনিক মাংস বৃদ্ধিও পরিমাণ জানা যায়। এটি নির্ণয় করার জন্য নিম্নের ফরমূলা ব্যবহার করা হয়।
পশুর দৈনিক মাংস বৃদ্ধির পরিমাণ দাঁড়াল= প্রকল্পের গরুর বিক্রয় করার সময় ওজন- প্রকল্প শুরুর সময় পশুর ওজন
                                                       সময়ের ব্যবধান (দিন)
২২.৩.৭ পশুর অন্যান্য যত্ন ও সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনা
পশুর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের উন্নতির আর একটি বাস্তব পদক্ষেপ। গরু মোটাতাজাকরণের জন্য কিকি করণীয় তা নিম্নে আলোচিত হলো।
১। প্রতিদিন পশুকে শরীর মেজে গোসল করাতে হবে এবং সংগে ব্রাস করলে ভাল হয়। এতে শরীরের পশম উজ্জ্বল ও চকচক করবে।
২। খাদ্য পরিবেশনার উপরও গরুর খাদ্য গ্রহণের তারতম্য হয়। যেমনঃ
·        নির্দিষ্ট সময়ে প্রতিদিন খাদ্য সরবরাহ করা।
·        গরুর সম্মুখে সর্বদা খাদ্য রাখা।
·        খাদ্য সরবরাহের আগে অবশ্যই পাত্র পরিষ্কার করা।
·        দানাদার খাদ্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ মেপে ২ বারে (সকালে ও বিকালে) পরিবেশন করা।
·        দানাদার খাদ্য আধা ভাঙ্গা অবস্থায় ভিজিয়ে খেতে অভ্যস্ত হলে সেভাবে দেয়া।
·        শুকনা দানাদার খাদ্য দিলে খাদ্য গ্রহণের পরপরই পানি দেয়া।
·        খড় কেটে ভিজিয়ে পরিবেশন করলে কম নষ্ট হয় এবং খাদ্যের গ্রহণযোগ্যতাও বাড়ে ।
·        খাদ্যে অবশ্যই মাটি/বালি থাকা খাদ্য পচা, বাসি, অতি পুরাতন না হওয়া।
৩। গরু যদি নিজ ইচ্ছায় নির্দিষ্ট পরিমাণ খাবার না খায় তবে বাঁশের চোঙা বা প­াষ্টিকের বোতলে করে জোর করে পেট ভর্তি করে খাওয়াতে হবে। কারণ পশু যত খাবে তত তাড়াতাড়ি শরীরের মাংস বাড়বে।
৪। প্রয়োজনের অতিরিক্ত নড়াচড়া করতে দেওয়া যাবে না।
৫। কোন প্রকার কাজে খাটানো যাবে না।
৬। উত্তেজিত বা বিরক্তত করা যাবে না।
৭। মশা-মাছি, আটালী থেকে পশুকে রক্ষা করতে হবে।
৮। পশুর কাছে সব সময় টিউবয়েলের টাটকা পানি থাকবে।
৯। বাসস্থান সব সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
১০। সপ্তাহে একদিন বাসস্থান, খাবার পাত্র জীবাণুনাশক ঔষধ যেমন আয়োসান (Iosan), সোডা, ডেটল/  স্যাভলন দ্বারা পরিষ্কার করতে হবে।
১১। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আলো বাতাস ঘরে রাখতে হবে।
১২। খাদ্য সংরক্ষণের জায়গা পরিষ্কার রাখতে হবে যাতে ইঁদুর বা কুকুর নষ্ট না করে।
১৩। দৈহিক ওজনের উপর ভিত্তি করে দানাদার খাদ্য সংরক্ষণ করতে হবে।
১৪। নিয়মিত কৃমিনাশক ঔষধ দিতে হবে।
১৫। প্রতিদিন পরিমাণমত কাঁচা ঘাস ও খড় দিতে হবে।
১৬। খাদ্যে ইউরিয়া দিতে হবে।
১৭। প্রতিনিয়ত বি- ভিটামিন দিতে হবে।
১৮। সময়মত সংক্রামক রোগ সমূহের টিকা দিতে হবে।
১৯। বাহিরের লোকজনকে গরুর কাছে যেতে দেওয়া যাবে না।
২০। সপ্তাহে একবার গরুর ওজন নিতে হবে।
২১। পশু অসুস্থ হলে সঙ্গে সঙ্গে নিটস্থ পশু হাসপাতালে নিতে হবে।

২২.৩.৮  এড়েঁ গরুকে খোঁজাকরণঃ
এড়েঁ গরুকে খোঁজাকরণের উদ্দেশ্য হলো পশু যাতে শান্ত হয় এবং দ্রুত শরীরে মাংস বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া খোঁজাকৃত পশুকে সহজেই নিয়ন্ত্রন করা যায়। এ জাতীয় গরুকে শিশু, মহিলা, বৃদ্ধ সবাই পরিচর্যা করতে পারে। তবে বাজারে এড়েঁ গরুর চাহিদা বলদ গরুর চেয়ে বেশী। আর যে সব পশু অস্থির, খাবারের প্রতি রুচি  তেমন থাকে না এবং ধাতু রোগে ভোগে ঐ সব গরুকে খোঁজা করা উচিত। এঁড়ে গরুকে খোঁজা করতে হবে তবে মুচি দ্বারা কখনো খোঁজা করানো যাবে না। নিকটস্থ সরকারী পশু হাসপাতালে যোগাযোগ করে বার্ডিজো  ক্যাস্টট্রেটর মেশিনের দ্বারা এঁড়ে গরুকে খোঁজা করতে হবে।  খুব সহজ উপায়ে বার্ডিজো ক্যাসট্রেটর দ্বারা এঁড়ে গরুকে খোঁজা করা যায়। বার্ডিজো দ্বারা গরুর শুক্রনালীতে চাপ দিলে শুক্রনালী ছিড়ে যায় ও রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায় ফলে শুক্র তৈরী হতে পারে না। দুই শুক্রনালীতে দুইবার চাপ দিতে হয়। বার্ডিজো ব্যবহারের পর ক্ষতস্থানে আয়োডিন বা বেনজিন দিতে হবে। বয়স্ক গরু বা মহিষ খোঁজা করতে হলে অপারেশন করতে হয়। এতে উক্ত গরুর উত্তেজিত ভাব কমে আসবে এবং খাওয়ার প্রতি মনোযোগী হবে।

২২.৩.৯ ক মোটাতাজাকরণ প্রকল্পের জন্য মেয়াদঃ
গরু মোটাতাজাকরণের জন্য নির্দিষ্ট মেয়াদ কাল একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ গরু দ্রুত মোটাতাজা হওয়ার নির্দিষ্ট সময় থাকে এবং এটি বিভিন্ন ফ্যাক্টরসমূহ যেমন- গরুর জাত, বয়স, খাদ্য ব্যবস্থাপনা, আবহাওয়া, মালিকের ব্যবস্থাপনা ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা ইত্যাদির উপর নির্ভরশীল। উল্লেখিত ফ্যাক্টরসমূহ বিবেচনা করে গরু মোটাতাজাকরণ প্রকল্পের মেয়াদকাল কম পক্ষে ৪ মাস হওয়া বাঞ্জনীয়। তবে সময়কাল নির্ভর করবে গরুর শারীরিক বৃদ্ধির হার ও বর্তমান বাজার দর। এ জন্য প্রতি সপ্তাহে গরুর ওজন নিতে হবে এবং শারীরিক বৃদ্ধির হার হিসাব করতে হবে যে প্রতিদিন কত গ্রাম বা কেজি মাংস শরীরে বৃদ্ধি হচ্ছে। যদি গরুর খাদ্য খাওয়া খরচের তুলনায় দ্রুত বাড়তে থাকে সে সময় গরু বিক্রয় না করা ভাল। তবে গরুর বাজার মূল্য যখন বেশী পাওয়া যাবে তখনই বিক্রয় বিবেচনা করা যায়। গরু মোটাতাজাকরণের মেয়াদকাল সাধারণতঃ ৪ মাস, ৬ মাস, ৮ মাস ও ১ বছর ব্যাপী করা যায়। আমাদের দেশের গরু মোটাতাজাকরণ প্রকল্পের মেয়াদকাল ৪ মাস ও ৬ মাস হয়ে থাকে। অধিকন্ত গরু মোটাতাজাকরণ প্রকল্পের মেয়াদকাল সম্পূর্ণরুপে নির্ভর করবে প্রকল্প গ্রহনকারীর উপর।                                          
২২.৩.৯ খ গরু মোটাতাজাকরণ প্রকল্পে বিনিয়োগ ও মুনাফার তথ্য রেকর্ডকরণ।
গরু মোটাতাজাকরণ প্রকল্পে বিনিয়োগ ও মুনাফার তথ্য রেকর্ডকরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। কারণ প্রকল্পে কত টাকা কি কি বিষয়ে খরচ হচ্ছে, কোন জাতের ও কোন বয়সের গরুও মাংসবৃদ্ধির হার কেমন, প্রতিটি গরু থেকে কত আয় হচ্ছে এবং বিক্রয় মূল্য অবশ্যই লিখিত ভাবে না থাকলে প্রকল্পটি লাভজনক কিনা তা বলা যাবে না। কারণ, ব্যানিজিকভাবে গরু মোটাতাজাকরণ খামার হতে হলে অবশ্যই গরু মোটাতাজাকরণ প্রকল্পে বিনিয়োগ ও মুনাফা তথ্য রেকর্ডকরণ করতে হবে। নিম্নে গরু মোটাতাজাকরণ প্রকল্পে বিনিয়োগ ও মুনাফার তথ্য সংক্রান্ত প্র -ফোরমা দেওয়া হলো সেই অনুযায়ী প্রকল্পের অর্থনৈতিক সমীক্ষা রেকর্ড করা যাবে। যে ফরমেট দেওয়া হলো তা প্রকল্প গ্রহণকারী এর সঙ্গে সংযোজন বা বিয়োজন করতে পারবে।
টেবিলঃ গরু মোটাতাজাকরণ প্রকল্পে বিনিয়োগ ও আয় ব্যয়ের রেকর্ড সংরক্ষণের জন্যএকটি প্রো-ফরমা
ক্রঃ নং গরু
ক্রয়ের
তাং
গরুর জাত গরুর
বয়স
ক্রয়ের সময় গরুর ওজন (কেজি) ক্রয়
মূল্য
খাদ্য গ্রহন খাদ্য বাবদ মোট খরচ চিকিৎসা বাবদ খরচ সর্বমোট খরচ বিক্রয় কালিন গরুর ওজন গরু বিক্রয়ের তাং কত দিন মোটাতাজা করা হয়েছে আয় নীট মুনাফা






দানা
দার
খড় কাঁচা ঘাস





গরু গবর



























































































২২.৩.গ গরু বাজারজাতকরণ
অধিক লাভে গরু বিক্রয় গরু মোটাতাজাকরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ বিষয়ে তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হবে নচেৎ পশুর প্রকৃত মূল্য পাওয়া যাবে না। ফলে প্রকল্প ফলপ্রসূ হবে না। তাই যে অঞ্চলে হাট বাজারে বেশী দাম পাওয়া যায় সেই সব হাটে এ গরু গুলোকে বিক্রয় করতে হবে। এছাড়া আমাদের দেশের ঈদুল আজহার মৌসুমে বিক্রয় করলে এসব গরুর দাম বেশী পাওয়া যায়। এছাড়া মাংসের জন্য এসব গরুর চাহিদা আমাদের দেশে সব অঞ্চলে আছে তবে ঢাকা ও চট্টগ্রামে এড়েঁ বা হেভী বলদ গরুর চাহিদা ব্যাপক। তাই ঢাকা বা চট্টগ্রামে বিক্রয় করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে অথবা ঐ অঞ্চলের গরুর ব্যবসায়ী বা কসাইদের সাথে যোগাযোগ করে+ প্রকল্পে তাদেরকে ডেকে এনে বিক্রয় করলে অধিক মুনাফা পাওয়া যাবে।


গরু মোটাতাজাকরণ (৫ টি গরু) প্রকল্পের আয় ব্যয়ের হিসাব

১।  স্থায়ী বিনিয়োগ


জমির উন্নয়ন
২৫,০০০/-

গরুর ঘর ২০ বর্গমিটার @ ২০০০/-
৪০,০০০/-

যন্ত্রপাতি
৫,০০০/-

অন্যান্য খরচ
৫,০০০/-

মোট
৭৫,০০০/-
২। উৎপাদন খরচ ( প্রতি ব্যাচে)


গরু ৫টি @ ১২০০০/-
৬০,০০০/-

খাদ্য খরচ- প্রতি গরু ৫০/- টাকা হারে ১২০ দিনের জন্য
৩০,০০০/-

ভ্যাকসিন ও চিকিৎসা
৫,০০০/-

অন্যান্য ব্যয় -  অপচয় ( যন্ত্রপাতি  ও ঘরের ১০%)
৪,৫০০/-

প্রতি ব্যাচে উৎপাদন ব্যয়
৯৯,৫০০/-
৩। বার্ষিক উৎপাদন ব্যয়
২,৯৮,৫০০/-
৪। সম্ভাব্য আয়


গরু ১৫ টি @ ২৫,০০০/-
৩,৭৫,০০০/-

গোবর
৪,০০০/-

মোট আয়
৩,৭৯,০০০/-
৫। বিনিয়োগ ব্যয় - ১%
৩,৭৫০/-
৬। নীট আয়
৩,৭৫,২৫০/-
৭। নীট মুনাফা ( ৩,৭৫,২৫০/- - ২,৯৮,৫০০/-)
৭৬,৭৫০/-

গরু মোটাতাজাকরণ (২০ টি গরু) প্রকল্পের আয় ব্যয়ের হিসাব

১।  স্থায়ী বিনিয়োগ


জমির উন্নয়ন
৫০,০০০/-

গরুর ঘর-৮০ বর্গমিটার @ ২০০০/-
১,৬০,০০০/-

যন্ত্রপাতি
১০,০০০/-

অন্যান্য খরচ
১০,০০০/-

মোট
২,৩০,০০০/-
২। উৎপাদন খরচ ( প্রতি ব্যাচে)


গরু ২০টি @ ১২০০০/-
২,৪০,০০০/-

খাদ্য খরচ- প্রতি গরু ৫০/- টাকা হারে ১২০ দিনের জন্য
১,২০,০০০/-

ভ্যাকসিন ও চিকিৎসা
২০,০০০/-

মজুরী ( শ্রমিক ১ জন, মাসিক বেতন ৩,০০০/- টাকা হিসাবে)
৩৬,০০০/-

অন্যান্য ব্যয় -  অপচয় ( যন্ত্রপাতি  ও ঘরের ১০%)
১৭,০০০/-

মূলধনের সুদ ১০%
২৩,০০০/-

প্রতি ব্যাচে উৎপাদন ব্যয়
৪,৫৬,০০০/-
৩। বার্ষিক উৎপাদন ব্যয়
১৩,৬৮,০০০/-
৪। সম্ভাব্য আয়


গরু ৬০ টি @ ২৫,০০০/-
১৫,০০,০০০/-

গোবর
১৫,০০০/-

মোট আয়
১৫,১৫,০০০/-
৫। বিনিয়োগ ব্যয় - ১%
১৫,০০০/-
৬। নীট আয়
১৫,০০,০০০/-
৭। নীট মুনাফা(১৫,০০,০০০/-  - ১৩,৬৮,০০০/-)
১,৩২,০০০/-


গবাদি পশুর রোগ ও স্বাস্থ্যবিধি

২৫ ১.১ গবাদি পশু সুস্থ থাকার লক্ষণ
·        পশু তার পারিপার্শিবক অবস্থার প্রতি সর্তক থাকবে ও স্বাভাবিক ভাবে নড়াচড়া করবে।
·        নাক, মুখ, চোখ পরিষ্কার ও উজ্জল থাকবে।
·        শরীরের লোম মসৃণ ও চকচকে থাকবে।
·        নাকের অগ্রভাগ ভেজা ভেজা ও বিন্দু বিন্দু ঘাম থাকবে।
·        কান ও ওলান নড়াচড়া করে মশা-মাছি তাড়াবে।
·        স্বাভাবিকভাবে খাওয়া দাওয়া করবে।
·        জাবর কাটবে।
·        পিপাসা স্বাভাবিক থাকবে।
·        মল-মূত্র স্বাভাবিক থাকবে।
·        শরীরের তাপ স্বাভাবিক থাকবে।
পশু অসুস্থ হলে উপরোক্ত অবস্থার ব্যাতিক্রম দেখা যাবে এবং যে রোগে আক্রান্ত হবে সেই রোগের লক্ষণ প্রকাশ পাবে।

২৫.১.২ রোগ জীবাণু ছড়ানোর মাধ্যম
পশুর দেহে বিভিন্ন ভাবে জীবাণু প্রবেশ করতে পারে। সাধারণতঃ মুখ-গহবর, নাসারন্ধ্র, চামড়ার ক্ষত, যোনি পথ, মল-মূত্র ত্যাগের রাস্তা, বাঁটের ছিদ্র, চোখ ইত্যাদির মাধ্যমে রোগের জীবাণু দেহের মধ্যে প্রবেশ করে।  গবাদি পশুর রোগ প্রতিরোধ করার জন্য রোগ জীবাণু ছড়ানোর উপায় সর্ম্পকে ধারণা থাকা দরকার। সাধারণতঃ নিম্নোক্তভাবে রোগ জীবাণু ছড়িয়ে থাকে।
১। বাতাসের মাধ্যমেঃঅনেক মারাত্মক রোগের জীবাণু বাতাসের মাধ্যমে একস্থান থেকে অন্যস্থানে ছড়িয়ে পড়ে। যেমন- ক্ষুরা রোগের জীবাণু ।
২। জীব জন্তু ও কীট পতঙ্গের মাধ্যমেঃকুকুর, বিড়াল, শৃগাল, বেজী, ইঁদুর, মশা, মাছি, বিভিন্ন কীট পতঙ্গ ইত্যাদি দ্বারা রোগ জীবাণু ছড়াতে পারে।
৩। বিভিন্ন ধরনের পাখীর মাধ্যমেঃকাক, চিল, শকুন ইত্যাদি নানা রকমের পাখীর মাধ্যমে রোগ জীবাণু ছড়াতে পারে।
৪। নদী, জলাশয়, বৃষ্টির পানি দ্বারাঃপ্রাণীর মৃতদেহ বা সংস্পর্শযুক্ত দ্রব্যাদি নদী, জলাশয় বা মাটিতে ফেলে রাখলে মৃতদেহ থেকে নিঃসৃত পদার্থ বা অন্যান্য দ্রব্যাদিতে লেগে থাকা রোগ জীবাণু পানির স্রোতে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে।
৫। হাট বাজারের পশু পাখী বা পশুজাত দ্রব্যাদির মাধ্যমেঃ অনেক সময় রোগাক্রান্ত বা সংস্পর্শযুক্ত পশুপাখি বিক্রয়ের জন্য হাট বাজারে নেওয়া হয়। এ সকল পশু পাখী পরিবহনের রাস্তা এবং বিক্রয় স্থলে রোগ জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে। হাটে বাজারের অন্যান্য সুস্থ পশু পাখী রোগাক্রান্তদের সংস্পর্শে এসে সংক্রামিত হয় এবং এইভাবে রোগ বিস্তার লাভ করে। তাছাড়াও আমাদের দেশের লোকজনের অজ্ঞতার কারণে হাট বাজার ও অন্যান্য স্থানে রোগাক্রান্ত পশু পাখীর মাংশ বিক্রি হয়, এসবের মাধ্যমেও রোগ জীবাণু ছড়ায়।
৬। পশু পাখী বহনকারী যানবাহনের মাধ্যমেঃবাস, ট্রেন,লঞ্চ , ষ্টীমার, নৌকা, প্রভৃতি যোগে পশু পাখী এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বহন করার সময় রোগাক্রান্ত বা রোগের বাহক থেকে ঐ সব যান বাহনে রোগের জীবাণু লেগে যায় পরে অন্যান্য মালামাল, পশু পাখী বা মানুষের মাধ্যমে তা বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে।
৭। পশুর চামড়া বা অন্যান্য দ্রব্য দ্বারাঃআমাদের দেশে রোগে মৃত পশু পাখী সাধারণতঃ মাঠে ঘাটে ফেলে দেওয়া হয় যা কোন ক্রমেই উচিত নয়। এ সব পশুর চামড়া, হাড় ও অন্যান্য দ্রব্যাদি মুচি বা অন্য লোকজন বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যায়, মৃত পশু যে রোগে মারা গাছে সে রোগের জীবাণু চামড়া, হাড় ও অন্যান্য দ্রব্যাদির মাধ্যমে বিভিন্ন স্থানে বিস্তার লাভ করে।
৮। পশু পাখীর পরিচর্যাকারী দ্বারাঃরোগাক্রান্ত পশুর পরিচর্যাকারী তার দেহ, পোষাক পরিচ্ছদ ও আনুসংগিক সরঞ্জামাদি দ্বারা রোগের জীবাণু অন্যত্র ছড়াতে পারে।
৯। পরিদর্শক দ্বারাঃখামার দেখতে বা বেড়াতে আসা লোকজনের মাধ্যমেও রোগ জীবাণু ছড়িয়ে পড়তে পারে। যেখান থেকে তারা এসেছেন সেখানে সংক্রমক রোগের প্রাদুর্ভাব থাকলে সে সকল রোগের জীবাণু বিভিন্নভাবে তাদের সাথে আসে।
২৫.২.১ সংক্রামক রোগের প্রতিরোধ ব্যবস্থা
সংক্রামক রোগের প্রতিরোধ করার জন্য নিম্নোক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
১। নতুন ক্রয় করা বা অন্য কোন ভাবে সংগৃহীত পশুকে এনেই খামারের অন্যান্য পশুর সঙ্গে রাখা যাবে না। তিন সপ্তাহ সময় সেগুলোকে পৃথকভাবে রেখে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। এই সময়ের মধ্যে যদি নতুন পশুর কোন রোগ লক্ষণ প্রকাশ না পায় তবেই খামারের পুরানো পশুর সঙ্গে রাখা যাবে।
২। বহিরাগত দর্শকদের খামারে প্রবেশের সময় পা জুতার তলা জীবাণুনাশক পদার্থ গুলানো পানিতে ডুবিয়ে নিতে হবে।
৩। যে সকল সংক্রামক রোগের প্রতিষেধক টিকা পাওয়া যায় সে সকল রোগের টিকা সঠিক সময়ে নিয়ম মত দিতে হবে। নিজের খামারে টিকা প্রদানের সাথে সাথে পার্শ্ববতী খামার বা পশু সমূহকেও একই টিকা প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে।
৪। পশুর খাদ্য টাটকা, নির্ভেজাল হতে হবে ও স্বাস্থ্য সম্মতভাবে নিজ খামারেই মিশ্রিত করতে হবে।
৫। কোন এলাকাতে সংক্রামক রোগ দেখা দিলে সে এলাকার পশু পাখী বা পশু পাখী জাত দ্রব্যাদি হাটে বাজারে বা ঐ এলাকার বাইরে যাতে যেতে না পারে সেজন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৬। খামারে বন্য জন্তু প্রবেশ ও চলাচল বন্ধ করতে হবে। তাছাড়া মশা-মাছি ইঁদুর ও অন্যান্য কীট পতঙ্গ ধ্বংস করতে হবে।
৭। খামারের রোগাক্রান্ত পশুর চিকিৎসা করতে হবে, ভাল হওয়ার সম্ভাবনা না থাকলে তা জবাই করে পশু চিকিৎসকের মতে মাংস খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হলে পশুর মরদেহ মাটির নীচে পুঁতে রাখতে হবে বা পুঁড়িয়ে ফেলতে হবে।


২৫.২.২ সংক্রামক রোগ দেখা দিলে গৃহীত ব্যবস্থা সমূহ

১। পৃথক করণঃখামারে বা কোন বাড়িতে রোগ দেখা দেওয়ার সাথে সাথে রোগাক্রান্ত পশু পৃথক করতে হবে ও চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পশুর কাজ কর্ম করার জন্য যদি একজন লোকই থাকে তবে প্রথমে সুস্থ পশুর কাজ কর্ম ও খাদ্য প্রদান করে অসুস্থ বা আক্রান্ত পশুর সেবা করতে হবে। যদি কোন পশু রোগাক্রান্ত বলে সন্দেহ হয় তাকে পৃথক করে পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে।
২। আক্রান্ত পশুর চিকিৎসা অথবা নির্মূল করণঃযে সকল রোগের চিকিৎসা আছে এবং চিকিৎসা করলে ভাল হয়ে যায় সে সকল ক্ষেত্রে চিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে হবে, কিন্তু যে রোগের চিকিৎসা করলেও পরিপূর্ণভাবে ভাল হয় না এবং রোগের বাহক হিসাবে পশুটির বেঁচে থাকার সম্ভাবনা থাকে সে সব পশুকে জবাই করে মৃতদেহ পুঁড়িয়ে অথবা মাটির নীচে পুঁতে রাখতে হবে।
৩। রোগাক্রান্ত এলাকার পশু বিক্রয় না করাঃরোগ দেখা দিলেই অনেক লোকের মধ্যে রোগাক্রান্ত পশু পাখী বাজারে বিক্রয়ের প্রবণতা দেখা যায়, এর ফলে রোগ দ্রুত বিস্তার লাভ করে। এ প্রবণতা অবশ্যই রোধ করতে হবে। রোগাক্রান্ত এলাকার পশু পাখী যেন বাজারে বা রাস্তায় বের না হতে পারে সেদিকে সবার দৃষ্টি রাখতে হবে।
৪। রোগাক্রান্ত পশু ও তার পরিচর্যাঃরোগাক্রান্ত পশুর সেবা বা আনুসাংগিক ব্যবস্থাপনা ভিন্ন লোক দ্বারা করানোই ভাল। রোগাক্রান্ত পশুর ঘরের সমস্ত কিছু পৃথক থাকতে হবে এবং তা সুস্থ পশুর ঘরে কখনই আনা যাবে না। রোগাক্রান্ত পশুর ঘরের ময়লা, আবর্জনা, খড়-কুটা সবই পুড়িয়ে ফেলাই উত্তম না হলে মাটিতে পুঁতে রাখতে হবে। প্রতিদিন ঘরে সুবিধাজনক কোন জীবাণু নাশক যেমন-স্যাভলন, আইওসান, ফিনাইল বা ডেটল ব্যবহার করতে হবে।
৫। মৃত দেহের সৎকারঃসংক্রামক রোগে আক্রান্ত পশু মারা গেলে তার দেহে প্রচুর পরিমাণে সংশি­ষ্ট রোগের জীবাণু থাকে। রোগে মরা পশুর মৃতদেহ পুঁড়িয়ে ফেলাই উত্তম না পারলে অবশ্যই মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। মৃত পশুর ঘরের সকল আসবাবপত্র সহ সংশি­ষ্ট অন্যান্য সকল কিছু এমনকি ঘরের দেওয়াল, বেড়া, সিলিং, সব কিছু জীবাণুনাশক মিশ্রিত পানি দিয়ে ধুয়ে দিতে হবে এবং এই ঘরে সঙ্গে সঙ্গে অন্য কোন সুস্থ পশু না তুলে কমপক্ষে ২-৩ সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে। মৃত পশু ঘর থেকে বের করার সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন পশুর দেহ থেকে কোন পদার্থ না পড়ে। এই সকল পদার্থে প্রচুর জীবাণু থাকে। সংক্রামক রোগে আক্রান্ত মৃত পশুর চামড়া ছাড়ানো যাবে না। মৃত দেহ মাটিতে পোঁতার পর খেয়াল রাখতে হবে যেন কুকুর, শেয়াল বা অন্য কোন বন্য জন্তু তা তুলে না ফেলে। মাটি চাপা দেওয়ার আগে মৃত দেহের উপর চুন, সোডা অথবা ব্লি­চিং পাউডার ছিটিয়ে দিতে পারলে ভাল হয়।
 ৬। প্রচারঃসংক্রামক রোগ দেখা দেওয়ার সাথে সাথে এলাকার জন সাধারণকে সে রোগ সম্পর্কে সচেতন করার ব্যবস্থা নিতে হবে। এ জন্য ঢোল, মাইক, প্রয়োজনে পত্র-পত্রিকায়, বেতার বা টেলিভিশনে প্রচারের ব্যবস্থা নিতে হবে।

২৫.৩.১ গবাদি পশুর সংক্রামক রোগের কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার

ভাইরাসজনিত রোগ
রোগের নাম কারণ লক্ষণ প্রতিকার
১। ক্ষুরারোগ এক ধরনের অতি সূক্ষ্ণ ভাইরাস দ্বারা হয়। এ রোগ মারাত্মক ছোঁয়াচে। আক্রান্ত পশু, খাদ্য, পানি, বায়ু এমনকি কাপড়-চোপড় ও মানুষের মাধ্যমে ছড়ায় মুখে, জিহবায় ও ক্ষুরায় ফোস্কা পড়ে। পরে ফোস্কা ফেটে ঘা হয়। মুখ দিয়ে লালা ঝরে। শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। পশু খেতে, হাঁটতে ও কাজ করতে পারে না। পশু  দুর্বল হয়ে যায়। গাভীর দুধ কমে যায়। এ রোগে বাছুরের মৃত্যুর হার বেশি। অসুস্থ পশুকে সুস্থ পশু থেকে আলাদা রাখা। সুস্থ সকল পশুদের ক্ষুরা রোগের টিকা দেয়া। প্রতিদিন গোয়াল ঘর জীবাণুনাশক যেমন ডেটল বা ফিনাইল দ্বারা ভালোভাবে ধুয়ে দেওয়া। পশুকে নরম খাদ্য সরবরাহ করা ও ক্ষতস্থানের চিকিৎসা করা।
২। জলাতঙ্ক ভা্ইরাস জনিত একটি মারাত্মক রোগ। কুকুর, বিড়াল ও অন্যান্য বন্যপ্রাণী এ ভাইরাস বহন করে। আক্রান্ত প্রাণীর লালায় এ ভাইরাস থাকে ও কামড়ের মাধ্যমে গবাদি পশু আক্রান্ত হয়। রোগের লক্ষণ দুরকম যথা (১) পাগলামী ভাব ও (২) নিস্তেজ ভাব। পাগলামী ভাবে পশু অন্য পশুকে আক্রমণ করতে চায়। মুখ দিয়ে লালা ঝরে ও পরে আস্তে আস্তে পক্ষাঘাত দেখা যায়। নিস্তেজ অবস্থায় পশু চুপচাপ থাকে। প্রথমে পিছনের অংশ অবশ হয়ে যায়। উভয় অবস্থাতেই পশুর চোয়ালের অবশতা দেখা দেয়। জিহবা ঝুলে পড়ে দৃষ্টি শূন্যতা দেখা যায় ও কিছুই গিলতে পারে না। এ রোগে চিকিৎসায় কোন ফল হয় না। পশুর আক্রান্ত স্থানে সাথে সাথে সাবান বা সাইট্রিক এসিড দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হয়। বেওয়ারিশ কুকুরকে মেরে ফেলতে হয় ও পোষা প্রাণীদেরকে প্রতিষেধক টিকা দিতে হবে।
৩। গো-বসন্ত এটি ভাইরাস জীবাণু দ্বারা ঘটিত মারাত্মক সংক্রামক রোগ। আক্রান্ত প্রাণীর সংস্পর্শে, খাদ্য, পানি, বাতাস, শ্বাস-প্রশ্বাস, গোয়ালার হাত, মশা-মাছির মাধ্যমে সুস্থ গবাদি পশু আক্রান্ত হয়। শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। মুখে ও খাদ্য নালীতে ঘা হয় পায়খানা প্রথমে শক্ত ও পরে পাতলা হয়। মুখে দুর্গন্ধ হয়। শ্বাসকষ্ট হয়। নাক ও চোখ দিয়ে স্রাব ঝরে। পশুর খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। আক্রান্ত পশু ২৪ ঘন্টা থেকে ৭ দিনের মধ্যে মারা যায়। আক্রান্ত পশুকে আলাদা ঘরে রাখা। সুস্থ পশুকে নিয়মিত টিকা দেয়া ও স্বাস্থ্যসম্মত লালন-পালন ব্যবস্থা করা।
৪। রিন্ডার পেস্ট এটি অত্যন্ত ছোঁয়াচে ভাইরাস জনিত রোগ। আক্রান্ত পশুর সংস্পর্শে, শ্বাস-প্রশ্বাস, মলমূত্র, খাদ্যদ্রব্য, পানি, বায়ু দ্বারা সুস্থ গবাদি পশু আক্রান্ত হয়। জ্বর হয়, চোখ, নাক মুখ দিয়ে পানি ঝরে ও নাকের পর্দা রক্তাভ হয়। মুখ দিয়ে লালা ঝরে। দুগন্ধযুক্ত আম ও রক্ত মিশ্রিত ডায়রিয়া হয়। দেহের তাপমাত্রা কমে যায় ও পশু ৭ দিনের মধ্যে মারা যায়। আক্রান্ত পশুকে আলাদা রাখা, সুস্থ পশুকে নিয়মিত টিকা দেয়া ও গোয়াল ঘরে জীবাণুনাশক ব্যবহার করা।

২৫.৪ ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ
রোগের নাম কারণ লক্ষণ প্রতিকার
১। তড়কা Bacillus anthracisনামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা এ রোগ হয়। এ রোগের জীবাণু মাটি থেকে সরাসরি ঘাস বা অন্য খাদ্যের সাথে মুখ দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে। আক্রান্ত প্রাণী হঠাৎ মারা যায় ও মৃত্যুর হার বেশি অতি তীব্র প্রকৃতির হলে পশু দ্রুত নিঃশ্বাস নেয় ও দেহ মাটিতে ঢলে পড়ে এবং খিচুনি দিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে মারা যায়। তীব্র প্রকৃতির হলে পশুর জ্বর আসে, তাপমাত্রা বেড়ে যায়। ক্ষুধামন্দা নিস্তেজ ও পেট ফাঁপা দেখা যায়। দ্রুত নিঃশ্বাস নেয় ও কাঁপতে থাকে। রক্ত মিশ্রিত পাতলা পায়খানা হয়। নাক, মুখ ও মল দ্বার দিয়ে রক্ত ক্ষরণ হয়। রক্ত জমাট বাঁধে না। এ রোগের জীবাণু সহজে মরে না বলে মৃত পশুকে মাটির নিচে পুঁতে ফেলতে হয় বা পুড়ে ফেলতে হয়। রক্ত জমাট বাঁধে না বলে  দেহে ও রক্তাক্ত মাটিতে জীবাণুনাশক ব্যবহার করতে হবে। আক্রান্ত পশুকে আলাদা রাখতে হবে ও সুস্থ পশুকে টিকা দিতে হবে।
২। বাদলা Clostridium chauvoeiনামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা এ রোগ হয়। বর্ষাকালে ও ২ মাস থেকে ২ বছর বয়সের পশুতে বেশি হয়। খাদ্য ও পানির মাধ্যমে এ রোগ সংক্রমিত হয়। এ রোগের জীবাণু স্পোর সৃষ্টি করে মাটিতে ৩-৪ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে। অতি তীব্র প্রকৃতির হলে পশু হঠাৎ মারা যায়। তীব্র প্রকৃতির হলে ক্ষুধামন্দা জ্বর, পেটে গ্যাস, নাকের শ্লেস্মা দেখা যায়। পশুর পায়ের মাংসপেশী আক্রান্তের ফলে পশু হাঁটতে পারে না ও খুঁড়িয়ে হাঁটে এবং মাংস পেশীতে চাপ দিলে পচ্ পচ্ শব্দ হয়। আক্রান্ত পশুকে আলাদা রাখতে হবে। মৃত দেহ মাটির নিচে পুঁতে রাখা বা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। সেঁতস্যাঁতে এলাকা চারণভূমি বা বাসস্থানের জন্য ব্যবহার করা যাবে না। বর্ষার ২ মাস পূর্বে ৬ মাস থেকে ২ বছরের সকল পশুকে টিকা দিতে হবে।
৩। গলা ফুলা Pasteurella multocidaনামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা এ রোগ হয়। সকল বয়সের পশুই আক্রান্ত হয়। বর্ষার পর সেঁতস্যাঁতে জমিতে চরালে এ রোগ বেশি হয় অসুস্থ পশুর সংস্পর্শ, লালা, মলমূত্র, দূষিত খাদ্য ও পানি দ্বারা এ রোগ ছড়ায়। অতি তীব্র প্রকৃতির হলে, হঠাৎ করে পশুর জ্বর আসে, তাপমাত্রা বেড়ে যায়, ক্ষুধামন্দা হয়, নাক, মুখ দিয়ে লালা ঝরে ও ২৪ ঘন্টার মধ্যে পশু  মারা যায়। তীব্র প্রকৃতির হলে উপরের লক্ষণ ছাড়াও প্রথমে গলার নিচে, পরে চোয়াল, বুক পেট ও কানের অংশ ফুলে যায়। শ্বাস নিতে কষ্ট হয় গলা বাড়িয়ে মুখ দিয়ে শ্বাস নেয়। অসুস্থ পশুকে আলাদা রাখা ও সালফোনিলামাইড জাতীয় ইনজেকশন ব্যবহার করা। মৃতদেহ সৎকার করা। সব সুস্থ পশুকে সুস্থ অবস্থায় নিয়মিত প্রতিষেধক টিকা দেয়া।
৪। ম্যাসটাইটিস বা ওলান প্রদাহ Streptococcus genusব্যকটেরিয়া, ফাংগাস ও মাইকোপ্লাজমা দ্বারা হয়। অস্বাস্থ্যকর সেঁতস্যাঁতে বাসস্থান ময়লা হাতে দোহন, বাঁটে বা ওলানে আঘাত, ওলানে দুধ জমাট বেঁধে থাকা ইত্যাদি কারণে রোগজীবাণু সংক্রমিত হয়ে রোগ সৃষ্টি করে অর্থাৎ সংক্রমিত ওলান ও দূষিত পরিবেশ এ রোগ সৃষ্টি করে। অতি তীব্র রোগের ক্ষেত্রে দুধের পরিবর্তন লক্ষণীয়, দুধ পাতলা ও কিছু জমাট বাঁধা হবে। ওলান লাল হয়ে ফুলে যায় ও গরম হয়। পশু ব্যথা অনুভব করে ও তাপমাত্রা বেড়ে যায়। ক্ষুধামন্দা, অবসাদভাব, জ্বর ইত্যাদি হয়। দীর্ঘস্থায়ী প্রকৃতির হলে দুধের পরিমাণ কমে যায় ও ক্রমাণ্বয়ে দুধ ছানার মত ছাকা ছাকা হয়। অসুস্থ পশুকে সুস্থ পশু থেকে আলাদা করা। গোয়াল ঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা। এ রোগ প্রতিরোধ করা খুব কঠিন, কারণ ওলানে কোন এন্টিবডি তৈরি হলে তা দুধের মাধ্যমে বের হয়ে যায়।

   
গবাদি পশুর পরজীবী ঘটিত, অপুষ্টি জনিত ও বিষক্রিয়া জনিত ও অন্যান্য রোগসমূহের কারণ লক্ষণ ও প্রতিকার

১। পরজীবী দ্বারা সৃষ্ট রোগসমূহ
(ক) দেহাভ্যন্তরের পরজীবী দ্বারা সৃষ্ট রোগসমূহ
রোগের নাম কারণ লক্ষণ প্রতিকার
(১) পাকান্ত্রিক গোলকৃমি রোগ গোলকৃমি দ্বারা সৃষ্টি রোগ। কৃমির ডিম, ভ্রূণযুক্ত কৃমির ডিম, কৃমির লার্ভায়, দূষিত পানি ও খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে বড় পশুতে এবং লার্ভাযুক্ত শাল দুধের মাধ্যমে বাছুর আক্রান্ত হয়। ডায়রিয়া, ক্ষুধামন্দা। ভগ্নস্বাস্থ্য ইত্যাদি প্রকাশ পাওয়া । বাড়ন্ত পশুর বৃদ্ধি কমে যায়। বয়স্ক পশুর উৎপাদন কমে যায় ও রক্ত শূন্যতা দেখা যায়। গোয়াল ঘর, আশপাশের জায়গা ও চারণভূমি পরিষ্কার রাখা। গোয়াল ঘরে নিয়মিত চুন ব্যবহার করা ও জলাবদ্ধ জমিতে পশুকে চরানো যাবে না।
(২) হ্যাম্পসোর Stephanofilaria assamensisপ্রজাতির কৃমি দ্বারা এ রোগ হয়। হাম্পে এ রোগ বেশি হয়। মাছির মাধ্যমে ছড়ায়। চর্ম প্রদাহ হয়, চামড়ার গুণগত মান ও মূল্য কমে যায়। গাভীর দুধ উৎপাদন কমে যায়। ক্ষতস্থানে মাছি না বসতে পারা, ক্ষতস্থান পলিথিন বা কাপড় দ্বারা ঢেকে দেয়া, মাছি তাড়ানো ঔষধ বা তারপিন তৈল ব্যবহার করা। নেগুভোন মলম ব্যবহার করে কৃমি ধ্বংস করা।

(খ) পাতাকৃমি দ্বারা সৃষ্টি রোগসমূহ
রোগের নাম কারণ লক্ষণ প্রতিকার
(ক) ফ্যাসিওলিয়াসিস পাতাকৃমিঃ ফ্যাসিওলিয়া প্রজাতির পশু শুকিয়ে যাওয়া, ডায়রিয়া, রক্ত স্বল্পতা ও সাব-ম্যান্ডিবুলার এডিমা দেখা যায়। কৃমির মাধ্যমিক পোষক ধ্বংস করা ও কৃমি নাশক খাওয়ানো এবং পশুকে সংক্রামণ থেকে মুক্ত রাখা।
(খ) প্যারামফিস্টোমিয়াসিস প্যারামফিস্টোমাস প্রজাতির পাতা কৃমি দ্বারা হয়। ক্ষুধামন্দা, দুর্বলতা, ডায়রিয়া, বদহজম হয়।
(গ) সিস্টোসোমিয়াসিস/ স্নোরিং ডিজিজ সিস্টোসোমা প্রজাতির পাতা কৃমি দ্বারা সৃষ্ট হয়। ডায়রিয়া, মলে রক্ত ও মিউকাস থাকে। ক্ষুধামন্দা, রক্তাল্পতা ও নিস্তেজভাব দেখা যায়। পশু নাক ডাকে ও ঘড় ঘড় শব্দ হয়।
(গ) ফিতাকৃমি সৃষ্ট রোগসমূহ
(ক) টেনিয়াসিস টেনিয়া প্রজাতির ফিতাকৃমি দ্বারা সৃষ্ট হৃৎপিন্ড সিস্ট, হৃৎপিন্ডে প্রদাহ ও হৃৎপিন্ডের অকৃতকার্যতা ঘটে। কৃমিনাশক প্রতিশোধক ব্যবহার
(ঘ) প্রোটোজোয়া সৃষ্ট রোগ
ব্যাবেসিওসিস ব্যাবেসিয়াগণ ভুক্ত আঁটুলি দ্বারা সৃষ্ট। আক্রান্ত পশুর জ্বর, রক্তাল্পতা ও হেমোগ্লোবিনইউরিয়া দেখা যায় আক্রান্ত পশুর সুষ্ঠু চিকিৎসা ও বাহক (আটুলি) নিয়ন্ত্রণ।
(ঙ) বহিঃদেহের পরজীবী দ্বারা সৃষ্ট রোগসমূহ
(ক) উকুন রোগ /পেডিকুলোসিস উকুন দ্বারা সৃষ্ট হয় অল্প আক্রমণে তেমন লক্ষণ বোঝা যায় না তবে মাঝারি প্রকৃতিতে দীর্ঘমেয়াদী চর্ম প্রদাহ হয়। চুলকানি, ক্ষুধামন্দা, দুর্বলতা, ওজন হ্রাস ও বাছুরের লোম পড়ে যায়। পশুর দেহ ব্রাশ করা, গোসল করানো, উকুন হাত দিয়ে মেরে ফেলা ও গোয়াল ঘরে ধোঁয়া দেয়া।
(খ) আঁটুলির আক্রমণ আঁটুলি অ্যানিমিয়া, অস্বস্তি বোধ, খাদ্য গ্রহণ হ্রাস, দৈহিক ওজন ও দুধ উৎপাদন কমে যায়। চুলকানি, রক্ত জমাট বাঁধা দাগ দেখা যায়, আঁটুলি বিভিন্ন রোগের বাহক হয়। পশুর দেহ ব্রাশ ও গোসল করানো, আঁটুলি ধরে মেরে ফেলা ও গোয়াল ঘরে ধোঁয়া দেওয়া।
(গ) মেঞ্জ মাইটের আক্রমণ দ্বারা সৃষ্ট চর্ম প্রদাহ, চুলকানি, লোম পড়া, খাদ্য গ্রহণ কমে যাওয়া, দুর্বল,স্বাস্থ্যহানী, চামড়া নষ্ট হয় ও পুঁজ সৃষ্টি হয়।
২। অপুষ্টি ও বিপাকীয় রোগসমূহ
রোগের নাম কারণ লক্ষণ প্রতিকার
(ক) দুগ্ধ জ্বর রক্তে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ কমে যাওয়া। ক্ষুধামন্দা, উত্তেজিত ভাব, মাথা ও পা কাঁপা, দাঁড়িয়ে থাকা, হাঁটতে গেলে টলতে থাকা, পিছনের পায়ের দুর্বলতার কারণে শুয়ে পড়া। পা গুলো ছড়াতে থাকে যা থলথলে ও দুর্বল দেখায়। ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড খাওয়ানো, দানাদার খাদ্যের সাথে ভিটামিন ডি ও ক্যালসিয়াম খাওয়ানো।
(খ) কিটোসিস গর্ভবতী গাভীর শর্করা খাদ্যের ক্রটিপূর্ণ বিপাকের কারণে সৃষ্ট বিপাকীয় রোগ। রক্তে গ্লুকোজের অভাব, খাদ্যে শর্করা জাতীয় খাদ্যের অভাবে এ রোগ হয়। ক্ষুধামন্দা, দুধ উৎপাদন কম, দানাদার খাদ্য খাওয়া বন্ধ করে কিন্তু খড় খেতে থাকে। খাদ্য গ্রহণে অনিহা, স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে, গাভীর শ্বাস-প্রশ্বাস, প্রস্রাব ও গোয়াল ঘরে অ্যালকোহলিক গন্ধ থাকে। সবকিছু অহেতুক চাটতে থাকে, টলমল করে। দাঁড়াতে পারে না, দেহে কাঁপুনি ও খিচুনি থাকে। গ্লুকোজ বা ডেক্সট্রোজ ইনজেকশন দিয়ে প্রতিরোধ করা যায়।

৩। বিষক্রিয়া
রোগের নাম কারণ লক্ষণ প্রতিকার
নাইট্রেট ও নাইট্রাইট বিষক্রিয়া শ্যামা, হেলেঞ্চা, বোরা ইত্যাদি নাইট্রেট যুক্ত ঘাস খেয়ে। ভূট্টা গেইচা, মূলা, সরিষাতে ৩% এবং নেপিয়ারে ৯.৮% নাইট্রেট থাকে বিধায় এসব ঘাস খাওয়ানো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। লালাক্ষরণ, ডায়রিয়া ও শ্বাসকষ্ট দেখা যায়, পেশীর কম্পন, দুর্বলতা, টলমল অবস্থা ও পরে মাটিতে শুয়ে পড়ে ও খিচুনি হয়। ১% এর অধিক নাইট্রেট যুক্ত ঘাস পশুকে না খাওয়ানো ও কাঁচা ঘাসের সাথে খড় মিশিয়ে খাওয়ানো।

টিকা সংরক্ষণ
সঠিক পদ্ধতিতে টিকা সংরক্ষণ না করলে টিকার গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যায়। টিকার বোতলের গায়ে বা অন্য কাগজে সংরক্ষণ নির্দেশনা লেখা থাকে। যে টিকা হিমু শুষ্ক অবস্থায় ভায়েলে থাকে সেগুলো শূন্য ডিগ্রির নিচের তাপমাত্রায় রেফ্রিজারেটরে বা ডিপফ্রিজে রাখতে হবে। মেয়াদ উত্তীর্ণ টিকা ব্যবহার করা উচিত নয়। টিকা কোল্ড চেইন সিস্টেমের মাধ্যমে ল্যাবরেটরী/গবেষণাগার থেকে গ্রাম পর্যায়ে পৌঁছে। এটি নিম্নরূপে ঘটে।

প্রাথমিক স্তর                        মাধ্যমিক স্তর                                  
                   oc                           oc
গবেষণাগার                    জেলা/উপজেলা                            ইউনিয়ন বা  গ্রাম                                
(-২০ হতে ১৫সে)                0c/ ৮c                            (৮-১৫ সেটিগ্রেড)

পরিবহনে ত্রুটি হলে টিকা বীজের গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যায়। কোল্ড চেইন এর উপাদান যেমন মানুষ, যন্ত্রপাতি ও কলাকৌশল। কোল্ড চেইন সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি যেমন কোল্ড রুম, ফ্রিজার রুম, রেফ্রিজারেটর রুম, ডিপ ফ্রিজার, আইস প্যাক ফ্রিজার, কোল্ড বক্স, ভ্যাকসিন ক্যারিয়ার, আইস প্যাক, রেফ্রিজারেট ও ট্রান্সপোর্ট ইত্যাদি। টিকা শীতল করে জেলা সদরে সরবরাহ করে শীতল কক্ষে বা ছোট ছোট ফ্লাক্সে বরফ দিয়ে ব্যবহারের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। টিকা প্রয়োগের সময়সীমা পর্যন্ত টিকার শীতলতা বজায় রাখতে হয়। নতুবা টিকার গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যায়।




                                         
















টিকার সঠিক ব্যবহারের জন্য বিবেচ্য বিষয়
১। যথাযথ তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা
২। ভ্যাকসিনের শিশি বা ভায়াল কখনোই সরাসরি সূর্যালোকের সংস্পর্শে আসবে না।
৩। সকালে অথবা সন্ধ্যায় যখন সূর্যের আলোর তীব্রতা কম থাকে তখনই টিকা প্রদান কর্মসূচি শুরু করতে হবে।
৪। সূর্যের আলোর সংস্পর্শে এড়িয়ে প্রস্ত্ততকারক কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের নির্দেশ মতো টিকা তৈরি করতে হবে।
৫। টিকা গোলানোর পর অতিদ্রুত ছায়াযুক্ত স্থানে বসে টিকা সঠিক পদ্ধতিতে ও সঠিক মাত্রায় স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে প্রয়োগ করা উচিত।
৬। অসুস্থ গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগিকে কখনোই টিকা প্রদান করা উচিত নয়।
৭। শীতকালে ভ্যাকসিন তৈরির ২ ঘন্টার ও গরম কালে ১ ঘন্টার ভিতর প্রয়োগ করতে হয়। টিকা প্রদানের বিলম্ব হলে গোলানো টিকার পাত্রের পাশে কিছুক্ষণ পর পর ঠান্ডা পানি অথবা বরফের টুকরা রাখতে হবে। 

সারণী ২৫.১ গবাদি পশুর বিভিন্ন রোগের টিকা প্রদানের শিডিউল
টিকার নাম মাত্রা কতদিন পর পর কোন বয়সে প্রয়োগ সংরক্ষণ তাপমাত্রা
তড়কা () গরু/মহিষ/ ঘোড়া ১ সিসি ১ বছর ৪ মাস ত্বকের নিচে সে.
বাদলা () বাছুর ৫ সিসি, ভেড়া/ছাগল ২ সিসি ৬ মাস ৪ মাস ত্বকের নিচে ৪-৮ সে.
ক্ষুরারোগ
ক) মনোভ্যালেন্ট
খ) বাই ভ্যালেট

৩২ মাত্রা ভায়েল

১৬ মাত্রা ভায়েল
৪ মাস ৪ মাস ত্বকের নিচে ৪-৮ সে.
গলাফুলা গরু ও মহিষ ২ সিসি ১ বছর ৬ মাস ত্বকের নিচে ২-৪ সে.
রিল্ডারপেস্ট গরু ও মহিষ ১ সিসি কয়েক বছর প্রতি বছর ত্বকের নিচে ৪-৮ সে.
জলাতঙ্ক কুকুর ৩ সিসি; গরু, মহিষ, বানর-৬ সিসি; বিড়াল-১.৫ সিসি ১ বছর
মাংসে -২০ সে.
অ্যান্টি র‌্যাবিস ক) কুকুর/বিড়াল (৩০ পাঃ ওজন)-৫ সিসি/দিন-৭ দিন
খ) কুকুর/বাছুর/ভেড়া/ছাগল-১০ সিসি/দিন-৭ দিন
গ) ঘোড়া/গাভী/মহিষ-৩০ সিসি/দিন ১৪ দিন
ঘ) বকনা/গাধা-২০ সিসি/দিন-১৪ দিন
ঙ) হাতি/উট-৬০ সিসি/দিন-১৪ দিন
১ বছর (১ মাস পর বুষ্টার ডোজ)
মাংসে -২০ সে.

সংগ্রহিত।

8 comments: